লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
সিনিয়র পেশ ইমাম
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ।
উৎস : দৈনিক যুগান্তর
প্রকাশ : ১৭ জুন, ২০১৬ ১৭:৩২:৩৩
সম্পদ পরিশুদ্ধ ও দারিদ্র্য বিমোচন করে যাকাত
বায়তুল মোকাররমের জুমআর খুতবা
যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। এটি ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম উপাদান। কোরআনে কারীমের ৩০টি আয়াতে যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি আয়াতে নামাজের সঙ্গে সঙ্গে এবং দুটি আয়াতে স্বতন্ত্রভাবে।
যাকাত শব্দটির অর্থ পবিত্রকরণ, পরিশুদ্ধকরণ, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ইত্যাদি। আর ইসলামী পরিভাষায়- ধনীদের সম্পদে আল্লাহর নির্ধারিত দেয় অংশ যাকাত। বস্তুত যাকাত হচ্ছে সম্পদশালীদের সম্পদে আল্লাহ নির্ধারিত সেই ফরয অংশ যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা অর্জন, সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নির্ধারিত খাতে ব্যয় বণ্টন করার জন্য দেয়া হয়।
যাকাত একদিকে দাতার ধন সম্পদকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে এর প্রবৃদ্ধি সাধন করে। অন্যদিকে দরিদ্রের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। যাকাত শুধু সম্পদকেই পরিশুদ্ধ করে না বরং যাকাতদাতার মন মানসিকতা এবং ধ্যানধারণাও পরিশুদ্ধ ও উন্নত করে।
আমাদের পূর্বের নবী-রাসূলদের উম্মতদের জন্যও যাকাতের বিধান ছিল। যেমন কুরআনে কারীমে হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত ইসহাক (আ.) ও হযরত ইয়াকুব (আ.) সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদেরকে বানিয়েছিলাম নেতা, তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথপদর্শন করত। তাদেরকে নির্দেশ করেছিলাম সৎকাজ করতে, নামাজ কায়েম করতে এবং যাকাত দিতে। তারা আমরাই ইবাদত করত।’ (সূরা আম্বিয়া-৭৩)।
হযরত ঈসা (আ.) দোলনায় থাকাকালেই বলেছিলেন, তিনি (আল্লাহ) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন ততদিন নামাজ ও যাকাত আদায় করতে যতদিন আমি জীবিত থাকি। (সূরা মারইয়াম-৩১) উম্মতে মুহাম্মদী তথা আমাদের ওপর যাকাত ফরজ করা হয় দ্বিতীয় হিজরী সালে।
যাকাতের ফযিলত
যাকাত ও সদকা মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়। এর দ্বারা যে সম্পদ ও যাকাতদাতা পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয় এ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, তাদের সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত) গ্রহণ করুন, এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন। (সূরা তাওবা-১০৩)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, জনৈক বেদুইন ব্যক্তি নবী কারীম (সা.) এর কাছে এসে বললেন, ‘আমাকে একটি আমল বাতলে দিন যা করলে আমি জান্নাতে যেতে পারবো। নবী করীম (সা.) বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে কোনো শরিক করবে না। ফরজ সালাত আদায় করবে। ফরজ যাকাত আদায় করবে এবং রমযানে সাওম পালন করবে। তিনি বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ, সে সত্তার কসম, আমি এ থেকে কিছু বৃদ্ধিও করব না এবং কমও করব না। তখন ওই ব্যক্তি ফিরে যাওয়ার সময় নবী করীম (সা) বললেন, জান্নাতি কোনো ব্যক্তিকে দেখে কেউ যদি আনন্দিত হয়ে চায়, তবে সে যেন এই ব্যক্তিকে দেখে নেয়।’ (বুখারী ১ম খণ্ড, ১৮৭ পৃষ্ঠা)
যাকাত না দেয়ার শাস্তি
অপরদিকে যাকাত ফরজ হবার পরও যদি কেউ তা প্রদান না করে তার ব্যপারে কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘ যারা সোনা বা রূপা পূঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে। সেদিন বলা হবে, এটাই তা, যা তোমরা নিজেদের জন্য পূঞ্জীভূত করতে। সূতরাং তোমরা যা পূঞ্জীভূত করেছিলে আস্বাদন কর।’ (সূরা তাওবা-৩৪-৩৫) তাফসীরবিদদের সর্বসম্মত মতে এ আয়াতে যাকাতের কথা বলা হয়েছে।
আর যাকাত না দেয়ার পরিণতি সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন, যেসব লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাদের কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করবেন। (বায়হাকি, সূত্র মিশকাত, ১৫৭ পৃ)
আবূ হুরায়রা (রা.) বর্ণিত অন্য এক হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ যাকে ধন সম্পদ দিয়েছেন, সে যদি তার যাকাত আদায় না করে তাহলে, কিয়ামতের দিন তা একটি বিষধর অজগরের রূপ ধারণ করবে। যার দু’চোখের ওপর দুটি কালো চিহ্ন থাকবে। কিয়ামতের দিন তা তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পাশে কামড়াতে থাকবে এবং বলবে, ‘আমিই তোমার সম্পদ, আমিই তোমার পূঞ্জীভূত ধন’। (বুখারী শরীফ)
যাকাত প্রদানের এই গুরুত্বের কারণে ইসলামের অন্য বিধান মানার পরও শুধুমাত্র যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা) জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। তাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ করবেন- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর কসম রাসূল (সা) এর সময়ে তারা যা যাকাত দিত তার একটি উটের রশি দিতেও যদি তারা অস্বীকার করে তাহলে অবশ্যই আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।
যাদের ওপর যাকাত ফরজ
স্বাধীন, পূর্ণ বয়স্ক ও সম্পদশালী মুসলমানের ওপর যাকাত ফরজ। সম্পদশালী বলতে- সাড়ে সাত তোলা (প্রায় ৮৮ গ্রাম) সোনা অথবা বায়ান্ন তোলা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) রূপা অথবা এর সমমূল্য পরিমাণ নগদ টাকার মালিককে বুঝায়। অবশ্য উক্ত সম্পদের ওপর চন্দ্র মাস হিসেবে পূর্ণ একটি বছর অতিবাহিত এবং ঋণমুক্ত হতে হবে। ঋণ বলতে যা এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে তাই বুঝায়। অলস ঋণ নয়।
যাদের যাকাত দেয়া যাবে
মহান আল্লাহ যাকাত প্রদানের আটটি খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘সাদাকা (যাকাত) তা কেবল ফকির ও মিসকিনদের জন্য, সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত লোকদের জন্য, যাদের চিত্তাকর্ষণ করা হয়; তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান, আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা-৬০)
সমর্থবান ও সম্পদশালী মসলমানদের ওপর যাকাত প্রদান করা অবশ্য কর্তব্য। অতএব আসুন, আমরা রহমত বরকতের এ মাসে যাকাত প্রদান করে অন্য সময়ের তুলনায় সত্তর গুণ বেশি সাওয়াবের অধিকারি হই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান কুরন। আমীন।