হাফেজ মাওলানা সাইয়্যিদ জুলফিকার জহুর। আলোকিত এ মানুষটি পরিচিত বহুমুখী প্রতিভায়। ধানমণ্ডি তাকওয়া মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। আল কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড রিসাইটেশন সোসাইটির চেয়ারম্যান সাইয়্যিদ জুলফিকার জহুরের ধর্মীয় অঙ্গনের পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানেও রয়েছে সমান পারদর্শিতা।
দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরা সম্পন্ন করার সঙ্গে দিল্লি কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। ডিগ্রি নিয়েছেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও। একজন যুগসচেতন আধুনিক আলেম ও আর্কিটেক্ট হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। রমজানের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন যুগান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানজিল আমির
যুগান্তর : রমজান হল অফুরান কল্যাণের মাস, রমজানের সেই অফুরান কল্যাণগুলো কী এবং তা অর্জন হবে কীভাবে?
সাইয়্যিদ জুলফিকার জহুর: রমজানের কল্যাণগুলো মোটামুটি তিন ধরনের। এক নাম্বার হল, পরিবেশগত কল্যাণ। রমজানে ইবাদাত ও ভালো কাজ করার একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সে আবহ মানুষের মাঝে ভালো ও উত্তমতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় হল শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ। রোজা ও অন্য আমলগুলোর প্রভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন হয়। এর মাধ্যমে একজন মানুষ তাকওয়ার পথে অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু রমজান শেষ হলে পরিবেশগত কল্যাণটি শেষ হয়ে যায়। ঠিকমতো সচেষ্ট না থাকলে শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষও অনেকটা হারিয়ে যায়। কিন্তু রমজানের একটি কল্যাণ তখনও বাকি থাকে, সেটি হল ফুরকান। কিন্তু এই ফুরকানকে ধারণ করার মানসিকতা ও বোধের অভাব রয়েছে আমাদের।
বিষয়টি হল, আল্লাহ আমাদের রমজান দান করেছেন কোরআন সহকারে, ফুরকান লাভ করার জন্য। কোরআন অধ্যয়নের ফলে একজন মানুষের অন্তরে যে বোধ সৃষ্টি হয়, সে বোধই তাকে জীবনভর কল্যাণের পথে উৎসাহিত করে এবং তার জীবনকে সঠিক ও সুন্দর পথে পরিচালনা করে।
যুগান্তর : একজন রোজাদার কীভাবে তার রোজার মূল্যায়ন করবে?
সাইয়্যিদ জুলফিকার জহুর : রমজান তো প্রশিক্ষণের মাস। রোজার মাধ্যমে একজন মুমিন তার ইন্দ্রিয় ও রিপুর সংযমের প্রশিক্ষণ লাভ করে। শিকারিরা যখন বন্য পশু শিকার করে, তখন বিভিন্ন কৌশলে ধীরে ধীরে বশ করে। তেমনি রমজানে ক্ষুধা, পিপাসা ও অন্যান্য কষ্টের মাধ্যমে শরীরের অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে আমরা বশ করি।
এভাবে তাকওয়ার শক্তি অর্জন করে ইন্দ্রিয় বা রিপুর মাধ্যমে পরিচালিত না হয়ে সেগুলোকে আল্লাহর হুকুম অনুসারে পরিচালনার চেষ্টা করি। এভাবেই রোজাদার তার রোজা থেকে উপকৃত হবে। কিন্তু তা না করে গড্ডালিকা প্রবাহে আমরা সবাই রোজা রাখছি, রোজার প্রকৃত মূল্যায়ন করছি না। এ জন্য আমাদের আত্মসমালোচনা করা দরকার।
রমজান এসেছে আমাদের কলুষিত আত্মাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করার জন্য। রমজানের এ সুযোগ যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে বাকি ১১ মাস আমাদের আত্মা সঠিকভাবে পরিচালিত হবে।
যুগান্তর : একটি দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে যাকাতের ভূমিকা কতটুকু?
সাইয়্যিদ জুলফিকার জহুর : দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় যাকাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সম্পদ মানুষের জীবনযাপন ও চিন্তাভাবনায় একটা বৈষম্য সৃষ্টি করে, ধনী-গরিবের মাঝে একটা দূরত্ব তৈরি করে। যাকাত এই বৈষম্য ও দূরত্ব কমিয়ে আনে। কারণ যাকাত কোনো করুণা নয়। একজন দিচ্ছে, আরেকজন নিচ্ছে। যে যাকাত নিচ্ছে তার যেমন হক রয়েছে, যে দিচ্ছে তারও হক রয়েছে। এখানে দু’জন দু’জনার কল্যাণের কথাই চিন্তা করে।
একজন যখন অপরজনের কল্যাণ কামনা করে, তখন দুটি জিনিস অনুপস্থিত থাকে। একটি হল লোভ, অপরটি ক্ষোভ। এই লোভ ও ক্ষোভ যখন মানুষের মাঝে কম থাকে তখন যার নেই, সে যার আছে তার জন্য হিংসা বিদ্বেষ করে না, পক্ষান্তরে যার আছে সে যার নেই তার জন্য অকাতরে দান করে থাকে।
এভাবে যাকাত ধনী-গরিবের দূরত্ব কমিয়ে আনে। আর এ দূরত্ব কমার ফলে সামাজিকভাবে কোনো বৈষম্য থাকে না। এবং সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। সুতরাং বলা চলে, দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্যতার জন্য নাগরিকদের সুন্দর মন দরকার। আর এ সুন্দর মন যদি তাকওয়াভিত্তিক পরিচালিত হয়, তাহলে কিছু পবিত্র মানুষ সৃষ্টি হবে। যারা দেশের অর্থনীতিকে সুন্দর ও স্বাবলম্বীর পথে পরিচালিত করবে।
যুগান্তর : দেশের বিত্তবানরা সঠিকভাবে যাকাত আদায়ে অবহেলা করে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে?
সাইয়্যিদ জুলফিকার জহুর : রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর হজরত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতের সময় কিছু সম্প্রদায় যাকাত প্রদানে গড়িমসি করছিল। তখন হজরত আবু বকর (রা.) বলেছিলেন, রাসূল (সা.)-এর সময় যারা বকরি যাকাত দিয়েছিল এখন যদি তারা বকরির রশিটা দিতেও অস্বীকার করে, তাহলে আমি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করব।
বিষয়টি হল, রাষ্ট্র যদি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তাহলে তাদের উচিত রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় করা। তবে এখানে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতার বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। তা না হলে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশংকাই বেশি। এ জন্য দরকার কিছু পবিত্র মানুষ ও পবিত্র পরিবেশের।
দেশের অর্থনীতিবিদ ও আলেমদের সমন্বয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র একটি যাকাত বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। যারা এনবিআরের মতো কঠোরভাবে সঠিক হিসাব প্রণয়ন করে নাগরিকদের যাকাত আদায় করবে। এমনটি সম্ভব হলে দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য হ্রাস পাবে। সামাজিক শৃংখলা ও দারিদ্র্য বিমোচনে তা ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
যুগান্তর : আপনার মুসল্লিদের কীভাবে যাকাত প্রদানে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন?
সাইয়্যিদ জুলফিকার জহুর : যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। তাই যাকাত আদায়ের গুরুত্ব ও এর খাতগুলো সম্পর্কে তো আলোচনা করি, তবে যে বিষয়টির প্রতি আমি বেশি গুরুত্বারোপ করি, সেটি হল যাকাতের হিসাব। কারণ সঠিক হিসাব না করে আন্দাজের ওপরে যাকাত দিলে তা পরিপূর্ণরূপে আদায় হবে না।
আর এখনকার বাস্তবতায় যাকাতের অনেক ধরণ রয়েছে। যেমন ব্যক্তিগত যাকাত, ব্যবসায়িক যাকাত, প্রাতিষ্ঠানিক যাকাত, শেয়ারের যাকাত ইত্যাদি। শুধু সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ ও সাড়ে বাহান্ন তোলা রুপার হিসাব দিয়ে এখন চলবে না।
আধুনিক অর্থনীতির এ সময়ে যাকাতের এসব খাত সম্পর্কে আমাদের মুফতিদের সচেতন হতে হবে। না হয় আধুনিক অর্থনীতিকেন্দ্রিক যাদের লেনদেন ও জীবনযাপন তাদের যাকাতের হিসাব সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হবে না। তাই এ বিষয়টি আমি বেশি গুরুত্বারোপ করি।
আর বিতরণের ক্ষেত্রে আমি বলি, গৎবাঁধা শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের চেয়ে যাকাত গ্রহীতাদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করতে। যেমন কোনো গরিব ছেলেকে আইসিটি কোর্স বা কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করলে সে আর আগামী বছর যাকাত নিতে আসবে না। বা কাউকে সামান্য পুঁজির ব্যবস্থা করলে সে ছোট কোনো ব্যবসা করল। এভাবে যাকাত প্রার্থীদের স্বাবলম্বী করার ব্যাপারে আমি মুসল্লিদের উৎসাহিত করি।
উৎস: দৈনিক যুগান্তর
প্রকাশ : ১৩ মে, ২০১৯,