ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো যাকাত। যা সম্পদকে পরিশুদ্ধ করে। যাকাত দেয়া সমাজের ধনী গরিব উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যাকাতের বিষয়ে সঠিক জ্ঞানের অভাব অনেকই বোধ করে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর নিজের পেজে এক লাইভ আলোচনার আলোকে আজকের লেখায় যাকাত সম্পর্কিত দুটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
এখানে যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না ও যাকাতের সম্পদের হিসাব এই গুরুত্বপূর্ণ দুই বিষয় নিয়ে খুব সহজভাবে আজহারীর আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে।
যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না
১. বানু হাশেম অর্থাৎ মহানবী (সাঃ) বংশের কাউকে যাকাত দেয়া যায় না। সহিহ মুসলিমের একটি হাদিস অনুযায়ী যেখানে মহানবী (সাঃ) নিজেই বলেছেন, তার বংশের কাউকে যাকাত দেয়া শোভনীয় নয়। কেননা যাকাত মূলত সম্পদকে পবিত্র করতে দেয়া হয়ে থাকে অর্থাৎ সম্পদের ময়লা পরিষ্কার করতে যাকাতের বিধান। তাই তা রাসূলের পরিবারের কাউকে যাকাত দেয়া শোভনীয় নয়।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী যদি বনি হাশেম বংশের কেউ দরিদ্র হয়ে থাকে এবং তাদের জন্য সহযোগিতা ভাতা বা নির্ধারিত খুমুশের (জিহাদ থেকে পাওয়া নির্ধারিত অর্থ) বিধান না থাকে সেক্ষেত্রে কতিপয় ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে তাদের যাকাত দেয়া যেতে পারে।
২. অমুসলিমদের যাকাত দেয়া যাবে না। এটি ধনী মুসলিমদের থেকে উত্তোলন করা হয় ও মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করা হয়। এটি হলো সাধারণ নিয়ম। হানাফি মাজহাব অনুযায়ী অমুসলিমদের সাহায্যের ক্ষেত্রে যাকাত ব্যতীত ভিন্ন ফান্ড থেকে তাদের অর্থ দেয়া যেতে পারে। তবে রাসূলের (সাঃ) সময় তিনি অনেক কাফের অমুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাদেরকেও যাকাত দিয়ে ছিলেন।
হেদায়া গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী যাকাত দানের আটটি খাতের মধ্যে চিত্ত আকর্ষণের জন্য যাকাত দেয়া যেতে পারে। হযরত আবু বকর (রা.) এর সময় থেকে দীর্ঘ সময় ব্যাপী অমুসলিমদের যাকাত দেয়ার বিষয়টি রহিত ছিল। কেননা তখন ইসলাম একটি সম্মানিত অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল যেখান থেকে অমুসলিমদের যাকাত দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন ছিল না। তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।
ইসলামি চিন্তাবিদ আলি আল কারাদার গবেষণাপত্র অনুযায়ী, বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী অমুসলিমদেরকেও যাকাত দেয়া যেতে পারে। এভাবে দানের ক্ষেত্রে অমুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যাকাত দেয়া যেতে পারে। অমুসলিম সমাজে যেখানে মুসলিমদের বসবাস সেখানেও তারা যদি যাকাত থেকে অমুসলিমদের দিয়ে থাকেন তবে সেটা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
৩. ধনীদের যাকাত দেয়া যাবে না। তবে মুসাফির বা পথিক ব্যক্তিগতভাবে তারা ধনী হলেও বিপদগ্রস্ত অবস্থায় পরলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে। পাশাপাশি যারা যাকাত ফাউন্ডেশনে চাকরি করছে তাদের যাকাতের অর্থ থেকে বেতন দেয়া যেতে পারে। তারা ধনী হলেও এটি গ্রহণযোগ্য।
৪. ঔরসজাত সম্পর্ক কাউকে যাকাত দেয়া যাবে না। অর্থাৎ দাদা-দাদী, নানা-নানী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের যাকাত দেয়া যাবে না।
৫. স্ত্রীকে যাকাত দেয়া যাবে না। কারণ স্ত্রীর ভরণপোষণ করা স্বামীর দায়িত্বের মধ্যে পরে।
এই পাঁচক্ষেত্রে সাধারণত যাকাত দেয়া যাবে না।
যাকাতের জন্য নির্ধারিত সম্পদের হিসাব
নিসাব পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হলে তার ওপর যাকাত ফরজ। স্বর্ণ ও রোপ্য দিয়েই রাসূল (সাঃ) নিসাব নির্ধারণ করেছেন। স্বর্ণের ক্ষেত্রে পরিমাণটি হলো সাড়ে সাত তোলা সোনা ও আর রৌপ্য বা রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে ৫২ তোলা। সকলের সুবিধার্থের জেনে রাখা ভালো এখানে তোলা ও ভরী একই একক। আর আন্তর্জাতিক হিসেবে ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ আর রুপার ক্ষেত্রে ৫৯৫ গ্রাম। কিংবা এই সমপরিমাণ দামের টাকা যদি কারো থেকে থাকে তবে তার ওপর যাকাত ফরজ।
তবে দামের তারতম্যের জন্য নিসাবের হিসাব ভিন্ন হয়ে থাকে। যেহেতু ১৮ ক্যারট ৭ ভরী স্বর্ণের বাজার মূল্য আসে সাড়ে তিন লাখ টাকা। তাহলে এই পরিমাণ অর্থ কারো কাছে থাকলে সেটা নিসাব পরিমাণ অর্থের সামিল হবে। কিন্তু ৫৯৫ গ্রাম রুপার দাম ৫২ হাজার যা স্বর্ণের তুলনায় ৭ ভাগ কম। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে ঠিক কোনটি ধরে নিসাব নির্ধারণ করা উচিত?
এবিষয়ে অনেকের মত পার্থক্য রয়েছে। তবে রুপার নিসাব অধিক গ্রহণযোগ্য। কেননা এতে দুই পক্ষই লাভবান হচ্ছে। কারণ রুপার নিসাব পরিমাণ অর্থ সমাজের অধিকাংশ মানুষের থেকে থাকে। এতে একটা বৃহৎ সংখ্যক মানুষের উপর যাকাত ফরজ হচ্ছে একইসাথে সমাজের অধিকাংশ দারিদ্র্য মানুষ সেই যাকাত পেয়ে উপকৃত হতে পারছে। অর্থাৎ যিনি যাকাত দিচ্ছেন তিনি পরকালে ও যিনি নিচ্ছেন তিনি ইহকালে লাভবান হচ্ছেন। তবে কেউ স্বর্ণ নিসাব হিসেবে ধরতে চাইলেও তাতেও ভুল নেই। সেটিও গ্রহণযোগ্য ও সেই ব্যক্তির যাকাতও আল্লাহর ইচ্ছায় অবশ্যই কবুল হবে।
যাকাত ফরজ হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত হলো, নিসাব পরিমাণ অর্থ এক বছর ব্যক্তির নিকট থাকতে হবে। তবে সময়সীমা হিসাব করতে হবে চান্দ্র বছর বা লুনার ইয়ার ধরে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারটি মূলত সৌর বছর হিসেবে করা। লুনার ইয়ারের সাথে এর পার্থক্য প্রায় ১১ দিনের অর্থাৎ লুনার ইয়ার অনুযায়ী ৩৫৩ দিনে এক বছর হয়। তাই চান্দ্র বছর অনুযায়ী যাকাতের নিসাবের হিসাব করতে হয়।
তৃতীয় শর্ত হলো, সম্পদটি সম্পূর্ণ ব্যক্তির মালিকানায় থাকতে হবে। চতুর্থ শর্ত হলো, সম্পদটি আমাদের অতিরিক্ত হিসেবে থাকতে হবে। অর্থাৎ নিজের সকল মৌলিক ও ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণের পর যদি ব্যক্তির নিকট নিসাব পরিমাণ অর্থ জমা থাকে কেবল তখনই তার ওপর যাকাত ফরজ হবে নতুবা নয়।
সর্বশেষ শর্ত হলো, ব্যক্তির উপর ঋণ থাকা যাবে না। ঋণ থাকলে তা যাকাতের অর্থ থেকে বাদ দিয়ে ধরতে হবে। তবে এখানে কিস্তিতে পরিশোধ যোগ্য ঋণ বাদ দেয়া যাবে না। কিস্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তি আগামী ১২ মাসের ঋণ যাকাত থেকে বাদ দিয়ে যাকাতে হিসাব ধরতে হবে। তবে যদি আভিজাত্য কোনো পণ্য কিনে ঋণ হয়ে থাকে সেটি যাকাতের অর্থ থেকে কোনো শর্তেই বাদ দেয়া যাবে না।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যবহৃত কোনো জিনিসের যাকাত হয় না। স্বর্ণালংকার ও রুপার অলংকার ব্যতীত। এতে মতো পার্থক্য থাকলে আবু হানিফার মত অনুসারে ব্যবহৃত স্বর্ণালংকার ও রুপার ব্যবহৃত অলংকারের জন্য যাকাত দিতে হবে।
(মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর ১৪/০৫/২০২০ তারিখের ফেসবুক লাইভ থেকে)