লেখক : ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎস : দৈনিক ইত্তেফাক
প্রকাশ : ১৬ জুলাই, ২০১৫ ইং ০০:০০ মিঃ
যাকাত আদায়ের মানবিক পথ খোঁজা
সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য তাদের সম্পদের ওপর ধার্য যাকাত প্রদান করা ধর্মীয় কর্তব্য। পবিত্র কোরআন শরীফে ৩০ বার যাকাত প্রদানের কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে ধর্মের প্রতি অনুগত মুসলমান যাকাত আদায় করে থাকেন। বড় অঙ্কের যাকাত আদায়কারীদের কেউ কেউ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি এবং টাকা বিতরণ করতে পছন্দ করেন। আর তখন বোঝা যায় দেশে যাকাত গ্রহীতা দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কেমন। প্রায় বছরই এ ধরনের যাকাত বিতরণ করতে গিয়ে মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হতে হয় দরিদ্র আর নিম্ন আয়ের অনেক মানুষকে। যাকাত বিতরণের সময় অব্যবস্থাপনার কারণে ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে মারা যান অনেক অসহায় মানুষ। একাধিকবার এমন অঘটন ঘটার পরও ঢাক-ঢোল পেটানো যাকাতদাতারা সতর্ক হন না। ফলে ভয়াবহ দুর্ভাগ্য মেনে নিতে হয়। এই ধারাবাহিকতার আপাতত শেষ ট্র্যাজেডি যাকাত নিতে এসে ময়মনসিংহে পদদলিত হয়ে ২৭ জনের মৃত্যু আর অনেকের আহত হওয়া।
মানবতার পক্ষে অসহায় দরিদ্রের কষ্ট লাঘবের জন্য যেখানে যাকাত ভূমিকা রাখবে সেখানে যাকাত প্রদানের পন্থা যখন অমানবিক হয়ে যায় তখন সে পন্থা পরিহার করাই কর্তব্য। যাকাত আদায়কারী যদি এই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হন তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানবতাকে রক্ষা করার জন্য নীতি-নির্ধারণ করা। ময়মনসিংহ ট্র্যাজেডির পর পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য আমরা জেনেছি। পুলিশ বলেছে কেউ এ ধরনের আয়োজন করলে যাতে পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করে। তেমন হলে পুলিশ নিরাপত্তা বিধানে ভূমিকা রাখবে। আমাদের মনে হয়েছে এটি একটি নরম পরামর্শ। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে পুলিশের পক্ষে এর চেয়ে কড়া বক্তব্য দেয়া কঠিন। কারণ এদেশে এক শ্রেণির মানুষ আছেন ধর্মকে—ধর্মের বাণীকে গভীরভাবে অনুধাবন না করে, পবিত্র কোরআনের বাণী তাফসিরের মাধ্যমে উপলব্ধি না করে শাব্দিক অর্থে মনগড়া ব্যাখ্যা করে ধর্মান্ধদের উস্কে দিতে চায়। তাই যাকাতের মত একটি ধর্মীয় কর্তব্য পালনে কী পরামর্শ দিতে গিয়ে বা আদেশ জারি করতে গেলে কোন মতলববাজ কেমন উন্মাদনা সৃষ্টি করবে এসব নিয়ে হয়তো সরকার পক্ষকে ভাবতে হয়।
তবে আমরা মনে করি মানবতা সুরক্ষার চেয়ে বড় কর্তব্য কিছু নেই। যাকাতের অর্থ সম্পদ মহান আল্লাহ সরাসরি গ্রহণ করেন না। যাকাতের অর্থ সম্পদ আসলে গরীবের হক। যাকাতের অর্থে দরিদ্রের কষ্ট লাঘব হলে তাতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি। সময়ের সাথে সাথে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতিতেও পরিবর্তন এসেছে। ছেলেবেলায় অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং স্বাধীনতার পর পর সাধারণ দরিদ্র মানুষের সঙ্গতি আর এখনকার নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গতির মধ্যে তফাত্ রয়েছে। সে যুগে চেয়ে-চিন্তে খাওয়া মানুষ, মুটে মজুর, রিকশাওয়ালা, নৌকার মাঝি এ শ্রেণির মানুষের আয়ে সংসার নির্বাহ অনেক কঠিন ছিল। তাদের গায়ে অর্ধ ছেঁড়া গেঞ্জি চোখে পড়তো বেশি। দুটো ভালো জামা বা লুঙ্গি ছিল না অনেকেরই। ঘরের বৌদের শাড়িতে অনেক তালি পরতো। এসব দরিদ্র মানুষ অপেক্ষা করতো রমজানের জন্য। এসময় হয়তো এক দুটো যাকাতের শাড়ি বা লুঙ্গি জুটবে। এদিয়ে বছরের অনেকটা সময় পাড় করে দেয়া যাবে। তাঁতীদের একটি বড় ব্যবসার সময় ছিল রমজান মাস। যাকাতের শাড়ি লুঙ্গি বিশেষ আয়োজনে বিক্রি হতো। ছোট-বড় যাকাতদাতা শাড়ি-লুঙ্গি জাতীয় পোশাক কিনতেন বেশি। যে যার গরীব আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে বিতরণ করতেন। এরকম ঢাক ঢোল পিটিয়ে যাকাত দেয়ার ঘটনা একবারেই যে ছিল না তা নয় তবে তার সংখ্যা ছিল কম। সেকালে যাকাত গ্রহীতাদের পদদলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করার ঘটনার কথা মনে করতে পারছি না।
ছোটবেলা থেকে পারিবারিকভাবেই শিখেছি যে কোনো দান খুব গোপনে করা ভালো। দাতা আর গ্রহীতাই শুধু জানবেন। আল্লাহ তাতেই সন্তুষ্ট হন। পরে বোখারি শরীফ পড়ে এ সংক্রান্ত হাদিস জানতে পারি। তাতে স্পষ্টভাবে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) নবী করিমকে (সা.) উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘আল্লাহ সন্তুষ্ট হন ঐ ব্যক্তির দানে যে কিছু দান করলো এবং তা এমন গোপনভাবে দান করলো যে, তার বাম হাতও জানতে পারলো না তার ডান হাত কি দান করেছে।’
এ তো গেল ধর্মীয় বিধান। আমাদের সামাজিক বাস্তবতা কী বলে? এখন ধনী দরিদ্র সকল শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ যা উপার্জন করছে তাতে তারা যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করতে পারছেন তেমন নয়। তবে অনেকটাই ভালো আছেন। এসময়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা মানুষের সন্ধান যে একেবারে পাওয়া যাবে না তেমনও নয়। তবে ছেঁড়া জামা, লুঙ্গি বা শাড়ি পরা মানুষের সংখ্যা যে অনেক কমে গেছে চারপাশে চোখ বুলালে তা স্পষ্ট হবে। শাড়ি লুঙ্গি কিনে পরার সামর্থ্য অনেকেরই বেড়েছে। তবে প্রশ্ন থাকছে তাহলে যাকাতের কাপড় নিতে আসা মানুষের চাপ এত কেন? আর তাতে দুর্ঘটনাই বা ঘটছে কেন? এদের মধ্যে একান্ত দায়ে পড়া মানুষ যে একেবারেই থাকে না এমন নয়। তবে বিনে পয়সায় পাওয়ার একটি সহজাত প্রবণতাও অনেক ক্ষেত্রে কাজ করে। এমন মন্তব্যে কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হতে পারেন, তবে বাস্তবতাকে কি অস্বীকার করা সম্ভব? মানুষের এই মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতাকে একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়। সম্প্রতি আমার এক সহকর্মী তার চার বছরের গবেষণা শেষ করে কানাডা থেকে ফিরেছেন। কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন কানাডায় কোনো কোনো সুপারমলে বছরে কখনো কখনো কোনো পণ্যের অস্বাভাবিক ছাড় দেয়া হয়। বিজ্ঞপ্তি টানানো হয় কোনো নির্দিষ্ট দিনে পণ্যটি কমদামে বেচা হবে। যেহেতু পণ্যের সংখ্যা সীমিত তাই দেখা যায় নির্দিষ্ট দিনে দোকান খোলার অনেক আগে ভোর থেকে ক্রেতারা লাইন দিয়েছেন। এদের অধিকাংশই অসচ্ছল নন। তবুও কমদামে কেনার একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা তাদের তাড়িত করেছে।
আমরা যাকাতদাতাদের দান করার স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টির ধৃষ্টতা দেখাতে চাই না। তবে নতুন করে ভাবার অনুরোধ করি। ঢাকঢোল পিটিয়ে মহানবীর পরামর্শের না হয় অন্যথা করলাম কিন্তু যাকাতদাতা হিসেবে আমি কি জানি ২০০০ গ্রহীতার সকলেরই এই শাড়ি-লুঙ্গি পাওয়া অপরিহার্য ছিল। তারচেয়ে ভালো ছিল না এলাকায় ঘুরে প্রকৃত গ্রহীতাদের তালিকা করে তাদের হাতে নীরবে পৌঁছে দেয়া? পাশাপাশি দু’একশ’ বা দু’এক হাজার টাকা অর্থ সাহায্যের বিকল্পও কি ভাবা যায় না?
আমাদের দেশে এখন সামর্থ্যবান ব্যক্তির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরি-বাকরির বিশেষ সুবাদের ধনাঢ্য মানুষ অনেক রয়েছেন সমাজে। নির্বাচনে মনোনয়ন প্রার্থীদের নির্বাচন কমিশনে দেয়া তথ্যের সূত্রে বহু কোটিপতির অভাব নেই। এদের বড় সংখ্যক যদি দারিদ্র্য বিমোচনের চিন্তা মাথায় রেখে যাকাত দিতেন তবে নিশ্চয় অনেক মঙ্গল হতো। ধরে নেই ময়মনসিংহের জর্দা কোম্পানির মালিক একটি বড় ও মহত্ পরিকল্পনা নিতে পারতেন। জানি না তিনি কত টাকার যাকাত দেন। আয়োজনে তো মনে হয় বেশ কয়েক লক্ষ টাকা যাকাত দিতে হয় তাকে। তিনি যদি তার এলাকা জরিপ করতেন তবে নিশ্চয়ই বেশ কিছু সংখ্যক পরিবারের খোঁজ পেতেন যারা কষ্টে আছেন সংসার নির্বাহে। এদের কারো একটি ভ্যানগাড়ি বা রিক্সা থাকলে সংসার চলে যেত। কোনো বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা রমণী বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টে আছেন। তাকে একটি গাভী কিনে দিলে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী— সবজি বিক্রি করেন বা ছোট পান, বিড়ি, চায়ের দোকান রয়েছে। পুঁজির অভাবে ডুবতে বসেছেন। দশ বারো হাজার টাকা পুঁজি পেলে সংসারটা বেঁচে যায়। একটি সেলাই মেসিন হলে একটি পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। একবারে হয়তো সকলের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে পাঁচ বছরের যাকাতে ২০০ পরিবারকে আলোর মুখ দেখানো সম্ভব। এভাবে সারা দেশ জুড়ে সামর্থ্যবানরা যদি পরিকল্পনা মাফিক দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখেন তবে এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে অনেক সময় দানের সাথে দাতাদের নানা রকম হিসেব-নিকেশ কাজ করে। কয়েক বছর আগে আমার এক বন্ধু তার এক আত্মীয়ের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বাড়ির কর্তা মারা গেছেন। তার চল্লিশা অনুষ্ঠান। গিয়ে দেখেন এলাহী কাণ্ড। আগের রাতে ২৫টি গরু জবাই করা হয়েছে। সারারাত মাংস তৈরি করা। সকাল থেকে থরে থরে ডেকচিতে বিরিয়ানী রান্না হচ্ছে। জেলা সদরের পাশে গ্রাম। আশেপাশের গ্রামগুলোতে আম দাওয়াত দেয়া হয়েছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজার হাজার মেহমান খাচ্ছেন। বাড়ির ভেতরে সামিয়ানা টানানো হয়েছে। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থা। স্থানীয় এমপি, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অফিসারবৃন্দ সকলে এসেছেন সেখানে। পরে আমার বন্ধুটি জানলেন সামনের উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে এই বাড়ি থেকে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এসব আয়োজন এরই প্রস্তুতি। বাড়ির কর্তার মৃত্যু উপলক্ষ মাত্র। আমাদের সমাজে বড় মানুষদের যাকাতও অনেক সময় এমন ধারার উপলক্ষ হিসাবে কাজ করে। আর এর ভয়ঙ্কর মাশুল গুণতে হয় দরিদ্র মানুষদের।
ময়মনসিংহের মর্মান্তিক ঘটনার পর সেদিন ধর্মমন্ত্রী মহোদয় বললেন যাকাত সরকারের যাকাত তহবিলে দিলে এতসব ঝামেলা হয় না। অবশ্যই এটি একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। তবে নিষ্ঠার সাথে যাকাত প্রদান করেন আমার এমন এক পরিচিত এই প্রসঙ্গে বললেন প্রস্তাবটি ভালো কিন্তু অনেকেই ভরসা পান না। দুর্নীতিযুক্ত প্রশাসনে যাকাত তহবিলের অর্থ যে যথাযথভাবে ব্যয় করা হবে এ নিশ্চয়তা কে দেবে? বাস্তবিকই এই আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া দুর্নীতি কমিয়ে আনা সহজ নয়। পাশাপাশি কঠিন মানুষের আস্থায় ফিরে আসা। আমরা এতসব বিবেচনায় যেতে চাই না। আমরা চাই যাকাত বিতরণের নামে এমন মর্মান্তিক ঘটনা আর না ঘটুক। প্রত্যেক যাকাত প্রদানকারী একজন দাতার কর্তব্য নিয়ে মানবিকভাবে তাদের দান প্রকৃত গ্রহীতার কাছে পৌঁছে দেবেন এটিই আমাদের প্রত্যাশা।