লেখক : মুফতি মুহাম্মদ আল আমিন- খতিব, মোল্লাপাড়া জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা।
উৎস : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
প্রকাশ : আপডেট: ২০১২-০৮-১৮ ৬:৩০:১২ পিএম
যাকাতের মাসায়িল
ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হল যাকাত। যাকাত হচ্ছে ধনীর সম্পদে গরিবের হক। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেছেন, “তোমরা নামাজ কায়েম কর ও যাকাত দাও। আর তোমরা নিজের জন্য যে ভালো কাজ আগেভাগে করবে তার সওয়াব ও পুরস্কার আল্লাহর কাছে পাবে।” (সূরা বাকারা, আয়াত ১১০)
তিনি আরও এরশাদ করেছেন, “আপনি গ্রহণ করুন তাদের মাল হতে যাকাত যা দ্বারা আপনি তাদের পাক পবিত্র করবেন”| (সূরা তওবা, আয়াত ১০৩)
যাকাত না দেয়ার শাস্তি:
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, “যারা স্বর্ণ-রূপা জমা করে রাখে এবং এগুলোকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না (অর্থাৎ যাকাত আদায় করে না) আপনি তাদের ভীষণ কষ্টকর শাস্তির সুসংবাদ (তিরস্কার স্বরূপ ব্যবহৃত) শুনিয়ে দিন। সেদিন তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশ দগ্ধ করা হবে এবং বলা হবে এগুলো তা-ই যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। অতএব যা জমা করে রেখেছিলে তার স্বাদ এখন আস্বাদন কর”। (সূরা তওবা, আয়াত ৩৪-৩৫)
প্রিয় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (সা.) বলেন, যে সম্প্রদায় যাকাত প্রদান করে না তাদের মহান আল্লাহ অবশ্যই দুর্ভিক্ষের আযাবে গ্রেফতার করেন। (জামউল ফাওয়ায়িদ, ১ম খ-, ১৪৩ পৃষ্ঠা)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যাকে আল্লাহ তায়ালা মাল দান করেছেন, আর সে তার যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার মালকে তার জন্য একটি মাথায় টাকপড়া অজগর সাপ স্বরূপ করা হবে। যার দু’টি চোখের উপর কালো দাগ থাকবে (অর্থাৎ অতিরিক্ত বিষাক্ত হবে)। এই সাপকে যাকাত প্রদানে অবহেলাকারীর গলার বেড়িস্বরূপ লটকে দেওয়া হবে। এই সাপ ওই ব্যক্তির মুখের উভয় পার্শ্বে দংশন করতে থাকবে এবং বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সংরক্ষিত অর্থ। (বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ১৮৮ পৃষ্ঠা)
যার জন্য যাকাত ফরজ:
যদি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে এবং তা একবছর অতিবাহিত হয় তাহলে তার উপর শতকরা আড়াই টাকা হারে যাকাত দেওয়া ফরজ।
নেসাব পরিমাণ সম্পদ যদি থাকে এবং এক বছর অতিবাহিত হয় তাহলে সে ব্যক্তির নিয়মিত আয় না থাকলেও যাকাত দিতে হবে। খেয়াল রাখবে, যাকাত আদায় করতে হবে আরবি বছর হিসেবে। ইংরেজি বছর হিসেবে নয়।
নেসাব পরিমাণ সম্পদ কাকে বলে?
ইসলামী শরীয়ত নির্ধারিত বিশেষ পরিমাণকে নেসাব বলে। একেক সম্পদের নেসাব একেক রকম। স্বর্ণের নেসাব হচ্ছে সাড়ে সাত ভরি। রূপার নেসাব হচ্ছে সাড়ে বায়ান্ন ভরি। শুধু টাকা থাকলে বা স্বর্ণ রূপা মিশ্রিত থাকলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার দাম ধরে হিসাব করতে হবে। অর্থাৎ এই পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি সম্পদ থাকলে শতকরা আড়াই টাকা হারে যাকাত দিতে হবে।
উল্লেখ্য, স্বর্ণ বা রূপার বিক্রয়মূল্য ধর্তব্য। কেউ যখন যাকাত দেবে তখন বাজার মূল্য যাচাই করে নেবে। কারণ, সময়ের পরিবর্তনে স্বর্ণ ও রূপার দাম ওঠানামা করে। তাই যাকাতের হিসাবও পরিবর্তন হয়।যেসব সম্পদ থাকলে যাকাত দিতে হবে (যদি তা নেসাব পরিমাণ হয়):
১. স্বর্ণ, রূপা, ব্যবহৃত-অব্যবহৃত অলঙ্কার, লকারে রাখা অলঙ্কার।
২. নগদ টাকা, চেক, ডেবিট কার্ডে জমা টাকা, প্রাইজবন্ড, বোনাসের জমা টাকা, হজ বা অন্যান্য উদ্দেশে জমা টাকা।
৩. কারেন্ট হিসাব, সেভিংস হিসাব, ফিক্সড ডিপোজিটে নিজের জমা দেওয়া অংশ।
৪. পাওনা টাকা, বাকিতে বিক্রি করা মালের পাওনা দাম (ফেরত পাওয়ার আশা থাকলে)।
৫. দেওয়া জামানত / সিকিউরিটি ডিপোজিট।
৬. বৈদেশিক মুদ্রা (টাকায় পরিবর্তিত পরিমাণ)।
৭. বিক্রয়যোগ্য পণ্য।
৮. কারখানা, দোকান, গোডাউন ও বাড়িতে রাখা মাল।
৯. ব্যবসায়িক কাঁচামাল।
১০. যৌথ ব্যবসায় নিজের অংশ যদি যাকাতের নেসাব পরিমাণ হয়।
যেসব সম্পদের যাকাত দিতে হবে না:
১. নিজের থাকার বাড়ি।
২. জমি, পুকুর, বাগান।
৩. ব্যবহৃত পোশাক, ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
৪. ঘর, দোকান, ফ্যাক্টরির ফার্নিচার (ব্যবহৃত-সোকেস, আলমারি, চেয়ার, টেবিল, এসি, জেনারেটর, ফ্যান ইতাদি)।
৫. ফ্যাক্টরির মেশিনপত্র।
৬. ভাড়া দেওয়া যানবাহন, নৌযান। অবশ্য এগুলোর আয় যদি নেসাব পরিমাণ পৌঁছে তাহলে যাকাত আসবে।
৭. ব্যবহারের গাড়ি, কম্পিউটার, মোবাইল, ফ্রিজ ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি, জমি, বাগান ইত্যাদি যদি ব্যবসার উদ্দেশে হয় তাহলে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে যাকাত আসবে। আর যদি ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশে হয় তাহলে এগুলো থেকে উপার্জিত আয়ের ওপরে যাকাত আসবে। নিজের থাকার বাড়িতে যাকাত নেই।
যাকাতের টাকা থেকে বাদ যাবে:
১. নিজের দেনা/ ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজনে নেওয়া ঋণের টাকা (যারা সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন তাদের জন্য এই মাসআলা প্রযোজ্য নয়)।
২. বাড়ি বানানোর জন্য নেওয়া হাউজ বিল্ডিং লোন।
৩. বাকিতে/কিস্তিতে কেনা পণ্যের মূল্য।
৪. পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোনের বকেয়া বিল।
৫. কর্মচারীদের বকেয়া বেতন।
অতএব, মোট সম্পদ – মোট দেনা = মোট যাকাতযোগ্য সম্পদ।পাওনা টাকা, জামানত, সিকিউরিটি ডিপোজিট ইত্যাদি হাতে আসার পর যাকাত আসবে। তখন সব বছরের যাকাত হিসাব করে একসঙ্গে দিতে হবে। তবে প্রতি বছর হিসাব করে দিয়ে দেওয়া উত্তম। ইনকামট্যাক্স দিলেও যাকাত দিতে হবে। গবাদি পশু ও ফসলের যাকাত বিশ্লেষণ সাপেক্ষ।
যাকাত দেওয়ার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাত:
১. গরীব ব্যক্তিকে।
২. গরীব আত্মীয়-স্বজন, ভাইবোন থাকলে তাদের আগে দিতে হবে। এতে দিগুণ সওয়াব (যাকাতের সওয়াব এবং আত্মীয়তা রক্ষার সওয়াব)। তবে দেওয়ার সময় যাকাত বলে দেওয়া ঠিক হবে না।
৩. বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, সন্তান-নাতিদের যাকাত দেওয়া জায়েজ নেই।
৪. মাদ্রাসার গরীব ছাত্রদের দেওয়া যাবে।
৫. মুসাফিরকে দেওয়া যাবে, যদি তার অর্থের দরকার হয়।
৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে।
৭. আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ দ্বীন প্রতিষ্ঠায় চেষ্টারত ব্যক্তিকে।
৮. যাকাতের টাকা মসজিদ মাদ্রাসার ভবন নির্মাণের জন্য দেওয়া যাবে না।
যাকাতের মাসআলা-মাসায়েল আমরা জানতে পারলাম। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ যাকাত হিসাব করে আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমীন