সম্প্রতি মুসলিম সভ্যতা অবক্ষয়ের কারণ ও সংস্কারের আবশ্যকতা শীর্ষক একটি অসাধারণ বই পড়লাম। বইয়ের লেখক স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ইসলামী গবেষক, ইসলামী স্টাডিজে কিং ফয়সাল পুরস্কার পাওয়া লেখক ড. এম উমর চাপড়া। বইটি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট (বিআইআইটি) থেকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা-বাড়ি # ৪, রোড # ২, সেক্টর # ৯, উত্তরা, ঢাকা।
ড. উমর চাপড়া বইটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন, লেস্টারের অনুরোধে লেখেন। এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে তিনি বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী ইতিহাস ও সমাজবিদ ইবনে খালদুনের বই ‘কিতাবুল ইবারের’ভূমিকা বা মুকাদ্দিমাহ থেকে জাতির উন্নয়ন ও অবক্ষয় তত্ত্ব তুলে ধরেন। খালদুন বলেছেন যে, উন্নয়ন ও অবক্ষয়ে ন্যায়বিচার ও সম্পদের ভূমিকা রয়েছে। মুকাদ্দিমাতে ইবনে খালদুন যেসব মূলনীতি বলেছেন তা হচ্ছে যে- ১. জনগণের সমর্থনেই শাসক ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে; ২. ন্যায়বিচার ব্যতীত উন্নয়ন সম্ভব নয়; ৩. উন্নয়ন ব্যতীত সম্পদ অর্জন করা যায় না; ৪. সম্পদ ছাড়া জনগণের সমস্যা সমাধান করা যায় না; ৫. শাসকের দায়িত্ব শরিয়ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহ ন্যায়বিচারের মাপকাঠিতেই মানুষের বিচার করবেন।
বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ড. উমর চাপড়া রাসূলুল্লাহ সা:-এর আগমনের পর কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিমদের যে উন্নয়ন হয়েছিল, তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। সে আমলে ইসলামের ভিত্তিতে ব্যক্তিপর্যায়ে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। মুসলিম শাসনাধীন সব এলাকা ছিল একটি সাধারণ বাজার। ফলে সব এলাকার দ্রুত উন্নয়ন হয়েছিল। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির অগ্রগতি হয়েছিল, নগরও সমৃদ্ধ হয়েছিল। জ্ঞান-জগতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল, অনেক কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল, বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন নতুন মাত্রা পেয়েছিল। স্বাধীন আইন ও বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ অধ্যায় পর্যন্ত তিনি মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজের অবক্ষয়ের ধরন ও কারণ আলোচনা করেছেন। কিছু লেখক ইসলামের উত্তরাধিকার আইনের মাধ্যমে ব্যাপক বণ্টনকে দায়ী করেছেন, এর ফলে পুঁজি গঠন হয় না। জাকাতকে এবং ওয়াক্ফকেও তারা দায়ী করেছেন। ড. উমর চাপড়া এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তার মতে, মুসলমানদের অবক্ষয়ের কারণ ছিল নির্বাচিত খিলাফত থেকে রাজতন্ত্রে ফিরে যাওয়া, যদিও তারা খলিফা পদবিটি ধরে রেখেছিলেন। তবে তাদের মধ্যে অনেক ন্যায়পরায়ণ শাসকও তৈরি হয়েছিলেন যেমন- ওমর ইবনে আবদুল আজিজ, আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশীদ, নূরুদ্দীন শহীদ, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। শরিয়তের নিয়ন্ত্রণ এভাবে অব্যাহত ছিল।
তিনি অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন সরকারের আয় থেকে ব্যয় বেশি করা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক পদ-পদবি বিক্রয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের কারণ ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থ সহায়তায় ভাটা, বেসরকারি খাতের কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা। দার্শনিক ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী ও রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব। তারা এসব বিষয়ে বিতর্ক করছিল যে স্রষ্টার প্রকৃতি কী রূপ, সৃষ্টি কি স্র্রষ্টার মতো চিরন্তন, এসব সমস্যা সমাধানে ইমাম গায্যালী, ইবনে রুশদ, ইবনে তাইমিয়া চেষ্টা করেন। যা-ই হোক, এর ফলে শেষ পর্যন্ত মুসলিম সমাজে রক্ষণশীলতা বৃদ্ধি পায়, সামাজিক ক্ষেত্রে ফিকাহশাস্ত্র স্থবির হয়ে পড়ে এবং নারীদের অবস্থার অবনতি হয়।
নবম অধ্যায়ে তিনি মুসলিমদের সম্ভাব্য সংস্কার কর্মসূচি সম্পর্কে আলাপ করেছেন। তিনি নৈতিক সংস্কারকে প্রথম গুরুত্ব দিয়েছেন। ন্যায়বিচার, উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনে উদ্যোগী হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি শিক্ষার প্রসার ও ক্ষুদ্রঋণ বিস্তার করার কথা বলেছেন। তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে যতই সময় লাগুক শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র ইসলামী খিলাফত বা রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যেহেতু ইসলামী পুনর্জাগরণ মুসলিম বিশ্বে দানা বেঁধেছে, তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সেকুলারিজম কায়েম করার চেষ্টা তুরস্কে, তিউনিশিয়ায় সফল হয়নি। তবে ভবিষ্যতে ফিকাহকে স্থবিরতা থেকে উদ্ধার করতে হবে, এ কাজ অনেকটা হয়েও গেছে। ভবিষ্যতে ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বইটি গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।
লেখক :শাহ্ আব্দুল হান্নান, সাবেক সচিব বাংলাদেশ সরকার।
উৎসঃ দৈনিক নয়াদিগন্ত
প্রকাশঃ ১৮ জুন ২০২০,