প্রয়োজনীয় অর্থ ও সম্পদের অভাবে মানব জীবন হয় বেদনাক্লিষ্ট, হতাশাগ্রস্ত ও নিরানন্দে ভরপুর। তাই গরিব মিসকীন ও অভাবগ্রস্ত বিশ্বাসী বান্দাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষে জাকাতকে অপরিহার্য করেছেন মহান আল্লাহ তা’আলা। যাতে মুসলিম মিল্লাতের কোথাও যেন অভাবও অনটন জেঁকে বসতে না পারে। যাকাতের নেসাব কী? কাদের দিতে হবে? জাকাত দেয়ার ফায়দা কী? এসব জানা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ। কারণ এগুলো না জানলে মানাও যাবে না। গতকাল রমজান মাসের শেষ জুমা তথা জুমাতুল বিদার খুৎবায় এ বিষয়টির প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। খতীবগণ তাদের বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, নিজ সম্পদ পবিত্র এবং বৃদ্ধি করতে প্রত্যেক মুসলিমের নেসাব পরিমাণ সম্পদ হলেই জাকাত দেয়া আবশ্যক। জাকাত ৮ প্রকার হক্কদারের সম্পদ যা আপনার সম্পদের সাথে মিলে রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব হক্কদার খুঁজে তার হাতে পৌঁছে দিয়ে আপনি বিপদমুক্ত হোন এবং আপনার সম্পদকে পবিত্র করুন। খতীবগণ আরো বলেন, প্রদর্শনী করে জাকাত বিতরণ বা নিম্নমানের লুঙ্গি-শাড়ী বিতরণ এবং লোক সমাগম ঘটানো ঠিক নয়। সঠিক হিসাব করে নেসাব পরিমাণ সম্পদ হলেই জাকাত প্রদান করতে হবে, তাহলে পরবর্তী বছর আপনার সম্পদ বৃদ্ধি পাবে এবং আপনি দ্বিগুণ পরিমাণ জাকাত দেবার ক্ষমতা অর্জন করবেন বলে আশা করা যায়।
সাদাকাতুল ফিতর আদায় প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখতে গিয়ে খতীবগণ বলেন, মাসব্যাপী রোজা পালনকালে মুসলিমদের নানা ধরনের ভুল হয়ে যায়। এগুলোর কাফফারা এবং ঈদ উদযাপনে দরিদ্রদের অংশগ্রহণ করানোর লক্ষ্যে সবার ওপর সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা অপরিহার্য করা হয়েছে। রমজানের শেষ জুমাবার আল-কুদস দিবসে বয়ানে খতীবগণের বক্তব্যে আরো ছিল ইতেকাফ, শবে কদর তালাশ এবং পবিত্র ঈদুল ফিতরের নানা আমলের বিবরণ। একই সঙ্গে পবিত্র রমজানে মুসলিমরা যে সংযম, মানুষের প্রতি যে দরদ-সহমর্মিতা প্রদর্শন করেছেন সারা বছর যেন তার অনুশীলন অব্যাহত থাকে সেকথাও মুসল্লিদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
খতীবগণ বলেন, একটি শিশু জানে যে, নদী-পুকুরে পানির নিচে গিয়ে পানি খেলে রোজা ভেঙে যায় এবং আল্লাহ তাআলা তা দেখতে পান। তাই সে পানি পান করে না, এমনকি ঘরের ভেতরে লুকিয়েও কোন কিছু খায় না। কিন্তু সমাজে অনেক লোক আছে, যারা রোজা রেখে খাদ্যে ভেজাল দেয়, অন্যের জমির আইল কাটে, ফাইল ঠেকিয়ে ঘুষ খায়। রোজা তাদের এসব অন্যায় কর্ম থেকে বিরত রাখতে পারে না। এরূপ রোজাদারের ব্যাপারে আল্লাহর নবীর (সা.) সতর্কবাণী শুনিয়ে খতীব সাহেবরা বলেন, ‘যারা মিথ্যা কথা, অন্যায় কর্মকান্ড পরিত্যাগ করলো না, তাদের খানাপিনা পরিত্যাগের আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই’। তারা সকলকে রমজান মাসের সংযম, শিক্ষা সারা বছর নিজেদের জীবনে ধরে রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
আল-কুদস দিবস উপলক্ষে ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করে খতীবগণ তাদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নে আল্লাহ তাআলার সহযোগিতা কামনা করেন। এছাড়াও দেশ, জনগণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করে খুতবা এবং নামাজ শেষে দোয়া করা হয়।
জুমাতুল বিদা হিসেবে রমজানের শেষ জুমাতেও রাজধানীর প্রধান মসজিদ বায়তুল মোকাররম, মহাখালীর মসজিদে গাউসুল আযমসহ সারা দেশের জামে মসজিদগুলোয় ঢল নামে মুসল্লির। মসজিদের ভেতর, বারান্দা, ছাদ এবং আশপাশের খালি জায়গা ভরে পার্শ্ববর্তী রাস্তায় নামাজ আদায়ে বাধ্য হন মুসল্লিরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মসজিদগুলোতে এরকম চিত্র দেখা গেছে। উত্তরা, গুলশান, বাড্ডা, বারিধারা, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, মিরপুর, গাবতলী, পুরাতন ঢাকার লালবাগ, বংশাল, নারিন্দা, ইসলামপুরসহ প্রায় সব মহল্লার মসজিদে বহুতল মসজিদের ছাদগুলো উপচে রাস্তায় জায়নামাজ বা পত্রিকা বিছিয়েও নামাজ পড়তে দেখা গেছে। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, গতকাল রমজানের শেষ জুমায় বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের মসজিদগুলোতে ছিল হাজারও মুসল্লির ঢল। দলমত, শ্রেণি, পেশা নির্বিশেষে এককাতারে সামিল হন নগরবাসী। জুমার নামাজের সময় থমকে যায় পুরো নগরীর কর্মচাঞ্চল্য। মসজিদ ছাড়িয়ে মুসল্লির কাতার মসজিদের বারান্দা, ছাদ এমনকি আশপাশের সড়কেও বিস্তৃত হয়। তপ্ত সড়কে নামাজ আদায় করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। আজানের আগেই মুসল্লিরা মসজিদমুখী হন। ইমাম ও খতিবগণ মাহে রমজানের ফজিলত বর্ণনার পাশাপাশি জাকাত ও শবে কদরের ফজিলত বর্ণনা করে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগির তাগিদ দেন। পবিত্র মাহে রমজানে নগরীর মসজিদগুলোতে মুসল্লির উপচেপড়া ভিড়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে খতিবগণ আশা প্রকাশ করেন, রমজানের পরেও এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে।
নগরীর ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, বায়তুশ শরফ জামে মসজিদ, অলিখাঁ জামে মসজিদ, বহদ্দারহাট জামে মসজিদ, কাজির দেউড়ি জামে মসজিদ, জাম্বুরি ময়দান জামে মসজিদ, লালদীঘি জামে মসজিদ, এনায়েত বাজার শাহী জামে মসজিদ, শাহসুফি হযরত আমানত খান (রহ.) দরগাহ মসজিদ, গরীবুল্লাহ শাহ দরগাহ মসজিদ, হযরত মিসকিন শাহ দরগাহ মসজিদ, বায়েজিদ বোস্তামী জামে মসজিদ, চন্দনপুরা জামে মসজিদ, মসজিদে দারুস সালাম, আবদুল হাকিম জামে মসজিদ, মক্কী মসজিদ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদসহ নগরী ও জেলার প্রতিটি মসজিদে ছিল মুসল্লির উপচেপড়া ভিড়।
যশোর ব্যুরো জানায়, গতকাল জুমাতুল বিদায় যশোরের মসজিদে মসজিদে ধর্মপ্রাণ মুসল্লির ঢল নামে। রমজানের শেষ জুমার নামাজে ভিন্ন এক পরিবেশ বিরাজ করে। আযানের আগে থেকেই মুসল্লিরা মসজিদের ছুটে যান। বয়স্ক শিশু কিশোরদের এক মিলনমেলা হয় মসজিদগুলোতে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যশোর জজ কোর্ট মসজিদ, কালেক্টরেট মসজিদ, মারকাস মসজিদ, নতুন খয়েরতলা জামে মসজিদসহ যশোরের শহর ও গ্রামের মসজিদে ছিল প্রায় একই চিত্র।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে আজান হবার পর থেকে মুসল্লিরা মসজিদ পানে আসতে থাকেন। খতিব সাহেবগণ খুৎবায় দিনটির তাৎপর্য, রমজান মাসের ফজিলত তুলে ধরেন। শবে কদরের জন্য বেশি ইবাদত-বন্দেগী করার আহবান জানান। জুমার নামাজে প্রতি মসজিদে ছিল উপচেপড়া ভিড়। মসজিদের ভেতর বাইরের আঙ্গিনা রাস্তা পর্যন্ত ছিল মুসল্লিতে ঠাঁসা। হযরত শাহমখদুম (রূ) এর দরগা মসজিদ, সাহেব বাজার বড় মসজিদ, সোনাদিঘী মসজিদ, টিকাপাড়া জামে মসজিদ, হেতেমখা বড় মসজিদ, নওদাপাড়া আহলে হাদীছ মসজিদ, রানীবাজার মাদরাসা মার্কেট মসজিদ, সাহেব বাজার আরডিএ মসজিদ, রাজারহাতা শাহী মসজিদসহ সব মসজিদ ছিল ভরা।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, মাহে রমজানের শেষ জুমা ‘জামাতুল বিদা’য় দক্ষিণাঞ্চলের মসজিদগুলোতে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ভিড় ছিল স¤প্রতিককালের সর্বোচ্চ। হাজার হাজার মুসল্লি জুমার আজানের আগে থেকেই মসজিদে প্রবেশ করে নফল ও সুন্নাত নামাজ আদায় করতে থাকেন। দুপুর সোয়া ১২টা থেকে সাড়ে ১২টায় জুমার আজানের পর থেকে খতিব ছাহেবগণ খুৎবা পূর্ববর্তী বয়ানে রমজান, জুমা ও জামাতুল বিদাসহ শবে কদরের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, মসজিদগুলোতে ছিল মুসল্লিদের উপচেপড়া ভিড়। বেলা ১২টা থেকেই বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থান মাহী সাওয়ার বলখী (রহ.) এর মাজার ও মাজার সংলগ্ন মসজিদে সমবেত হতে থাকে মুসল্লিরা। ১০ সহস্রাধিক মুসল্লি এখানে জুমার নামাজ আদায় করেন। এছাড়া বগুড়ার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও বগুড়া বায়তুর রহমান সেন্ট্রাল মসজিদে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি জুমার নামাজ আদায় করেন। এছাড়া পাড়া-মহল্লার মসজিদগুলোতেও ছিল মুসল্লিদের ঢল।
খুলনা ব্যুরো জানায়, গতকাল টাউন হল মসজিদ, খুলনা কালেক্টরেট জামে মসজিদ, টুটপাড়া বড় জামে মসজিদ, পশ্চিম টুটপাড়া জামে মসজিদ, নূর-এ-মোহাম্মাদীয়া জামে মসজিদ, খুলনা আলিয়া মাদরাসা জামে মসজিদ, নিরালা কবরস্থান জামে মসজিদ, ইসলামাবাদ জামে মসজিদ, দারুল বারাকত জামে মসজিদ, মনোয়ারা মার্কেট পাঞ্জেগানা মসজিদ, শাহী জামে মসজিদ, এবং খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জেলার প্রধান প্রধান মসজিদগুলোতে ছিল একই অবস্থা। মসজিদের ভিতর এবং বারান্দায় স্থান না হওয়ায় মুসুল্লিগণ সূর্য্যরে তাপ ও গরম উপেক্ষা করে মসজিদ সংলগ্ন রাস্তা ও উন্মুক্ত স্থানে অবস্থান নিয়ে জুমার নামাজ আদায় করেছেন।
সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে জুমাতুল বিদায় গ্রাম-শহর-নগরের সকল মসজিদে ছিল মুসল্লিদের ব্যাপক উপস্থিতি। পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবার হওয়ার সিলেটের মসজিদগুলোতে ছিল মুসল্লিদের উপচেপড়া ভিড়। এসময় ক্রন্দনরত অবস্থায় মুসল্লিরা দেশ ও মুসলিম উম্মাহর পাশাপাশি পরিবার ও ব্যক্তি জীবনের শান্তি ও সফলতার জন্য দোয়া করেন। সিলেটের হজরণ শাহজালাল (রহ.) জামে মসজিদ, শাহপরাণ (রহ.), সিলেট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, সিলেট কালেক্টর মসজিদ, কুদরত উল্লাহ মসজিদ, হাওয়াপাড়া জামে মসজিদ, আম্বরখানা জামে মসজিদ, কদমতলী চৌমুহনী জামে মসজিদ, টিলাগড জামে মসজিদ, কুচাই জামে মসজিদ, ভার্থখলা জামে মসজিদ, শেখঘাট জামে মসজিদসহ সিলেটের প্রত্যেক মসজিদে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জ জেলার মসজিদগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। রমজানের রহমত, বরকত, মাগফেরাত বা নাজাত কোনটা থেকেই যেন মুসল্লিরা বঞ্চিত না হন সেজন্য প্রায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেই স্থান সঙ্কুলান হয়নি পুরো রমজানজুড়ে প্রায় সব মসজিদে। মসজিদের ভেতর ও বারান্দা ভরে গেলে অনেক মসজিদে বাধ্য হয়ে খোলা আকাশের নিচে প্রখর রোদ উপেক্ষা করে মসজিদের বাইরেও জুমা আদায় করতে কেউ দ্বিধা-সঙ্কোচ করেনি। কেন্দ্রীয় মসজিদের পেশ ইমাম আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, রমজান মুসলমানদের ট্রেনিং এর মাস। এই প্রশিক্ষণ বাকী ১১ মাস পালন করতে পারলেই রোজার মাহাত্ম্য পাওয়া যাবে।
উৎস: দৈনিক ইনকিলাব
প্রকাশ : ১ জুন, ২০১৯