জাকাত দেবেন কাকে
সুরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াত অনুযায়ী
* ফকির
* মিসকিন
* জাকাত আদায়কর্মী
* নও মুসলিম ও অনুরাগী
* দাস–দাসী
* ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি
* মুজাহিদ
* বিপদগ্রস্ত মুসাফির
৫২ তোলা রৌপ্য অথবা সমমূল্যের নগদ অর্থ বা ব্যবসা পণ্য থাকে, তবে তঁার সম্পদের শতকরা আড়াই শতাংশ হিসাবে আল্লাহর নির্ধারিত খাতে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করতে হয়
সারা বছর নিজের ও পরিবারের যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে কোনো মুসলমানের কাছে নিসাব পরিমাণ অর্থাৎ কমপক্ষে সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা সমমূল্যের নগদ অর্থ বা ব্যবসা পণ্য থাকে, তবে তঁার সম্পদের শতকরা আড়াই শতাংশ হিসাবে আল্লাহর নির্ধারিত খাতে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করতে হয়—এটাই হলো জাকাত। ধনসম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ অসহায় গরিব-দুঃখীদের জাকাত প্রদান করে মুমিনের আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে থাকেন। জাকাত গরিবের প্রতি ধনীর অনুগ্রহ নয়; বরং তাদের ন্যায্য অধিকার। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘তাদের (সম্পদশালীদের) ধনসম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক।’ (সুরা আল-জারিআত, আয়াত: ১৯)
জাকাত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রমজান মাসই জাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। ফলে বিত্তবানেরা দান-সদকা ও জাকাত-ফিতরা প্রদানে উৎসাহিত হন। রমজান মাসে দান-সদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি নেকি হয়। যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য একটি নফল ইবাদত করেন, তবে তিনি মাহে রমজানে একটি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবেন। যিনি একটি ফরজ আদায় করবেন, তিনি অন্যান্য মাসের ৭০টি ফরজের সমান সওয়াব পাবেন। তাই রমজান মাসে রোজাদার মুমিন বান্দারা একসঙ্গে গরিবের হক জাকাত ও ফিতরা—এ দুটি আর্থিক ইবাদত করে থাকেন।
দারিদ্র্য দূরীকরণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে জাকাত শ্রেষ্ঠতর উপায়। রোজাদার ধনী লোকেরা অসহায়দের জাকাত প্রদান করার ফলে সমাজের গরিব-নিঃস্ব ব্যক্তিরা দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে রেহাই পায় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়। ধনী মুসলমানদের অর্থসম্পদের মধ্যে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী গরিবের নির্দিষ্ট পরিমাণ অধিকার রয়েছে। অন্যের এ ন্যায্য প্রাপ্য বা হক প্রদান করলেই অবশিষ্ট ধনসম্পদ পবিত্র হয়ে যায়। রমজান মাসে ধনী লোকেরা দরিদ্রদের জাকাত প্রদানের ফলে উভয় শ্রেণির মানুষের মধ্যে লেনদেন হয় এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। তাই নবী করিম (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘জাকাত ইসলামের সেতু।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বস্তুরই একটি জাকাত রয়েছে, আর মানুষের দেহের জাকাত হলো রোজা।’ (ইবনে মাজা)। রোজাকে দেহের জাকাতস্বরূপ বলা হয়েছে, জাকাত আদায় করলে যেমন মানুষের উপার্জিত সব সম্পদ পবিত্র হয়, তেমনি রমজান মাসে রোজা পালন করলে সারা শরীর পবিত্র হয়ে যায়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদের জাকাত প্রদান করে, তার সম্পদের দোষ দূর হয়।’ বস্তুর পবিত্রতা হাসিলের জন্য যেমন জাকাত প্রদান করতে হয়, তেমনি মানুষের শরীর তথা আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য সত্যিকারের সিয়াম পালন করতে হয়।
জাকাত সমাজে ধনী ও গরিবের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণের একটি বিরাট উপকরণ। কোনো ব্যক্তির উপার্জিত অর্থের পুরোটাই এককভাবে তাঁকে ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয়নি, বরং বছরান্তে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলে এর দ্বারা গরিব আত্মীয়স্বজন, নিঃস্ব, হতদরিদ্র লোকজনকে সাহায্য করতে হয়; যাতে তারাও উপার্জনক্ষম হতে পারে। জাকাত প্রদান করলে জাকাতদাতার ধনসম্পদ কমে না, বরং আল্লাহ এতে অনেক বরকত দান করেন এবং তা বহুগুণ বেড়ে যায়।
সঠিক হিসাব অনুযায়ী জাকাত প্রদান করা হলে পুরো সম্পত্তিই হালাল হয়ে যায়। জাকাত হিসেবে যেকোনো পরিধেয় বস্ত্রের চেয়ে নগদ অর্থ পেলেই মনে হয় গরিব অসহায় মানুষেরা অধিকতর খুশি হবে। জাকাতের নগদ অর্থ দিয়ে তারা প্রয়োজনে পছন্দমাফিক কাপড়চোপড় কিনবে, নয়তো সংসার নির্বাহে ব্যয় করে সাময়িকভাবে অভাব দূর করতে পারবে। শাড়ি-লুঙ্গির চেয়ে তাদের সাংসারিক অনটন ও দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে উপযুক্ত হারে নগদ অর্থ দ্বারা জাকাত আদায় করা হলে তারা সত্যিকারভাবে উপকৃত হবে।
প্রত্যেক ধনী ব্যক্তিরই জাকাত আদায় করা উচিত। রমজান মাসে বঞ্চিত ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় ও সমাজের ধনী-দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে জাকাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জাকাতের প্রকৃত হকদার হচ্ছে তারা, যারা কর্মক্ষমতাহীন এবং কর্মক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা উপার্জনহীন অথবা পর্যাপ্ত পরিমাণে উপার্জন করতে পারছে না। ধনী লোকেরা যদি রমজান মাসে আর্থিক ইবাদত হিসেবে অগ্রিমও জাকাত আদায় করেন, তাহলে সব ধরনের গরিব মানুষের অভাব দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান সহজ হতে পারে। জাকাতকে সঠিক খাতে এবং সহায়-সম্বলহীন দুস্থ-এতিমদের ত্রাণ-পুনর্বাসনের কাজে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে সমাজ থেকে অভাব-অনটন ও দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হবে।
ইসলামি বিধান অনুসারে জাকাত প্রদানের ফলে সমাজের অসহায় গরিব-দুঃখী, অনাথ, বিধবা, বৃদ্ধ, রুগ্ণ, পঙ্গু, অক্ষম ও ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে অভাব মোচন করতে পারে। জাকাতের অর্থ-সম্পদ অভাবী ও দুস্থ মানুষের হাতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বণ্টিত হলে তাদের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হয়। ধনী লোকেরা যদি ঠিকমতো জাকাত আদায় করেন, তাহলে সমাজে কোনো অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, শিক্ষাহীন লোক থাকতে পারে না। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো বান্দা জাকাত আদায় করে, তখন ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করে।’
লেখক: ড. মুফতি মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী, অধ্যাপক, উর্দু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়|
উৎস: দৈনিক প্রথম আলো
প্রকাশ : ২৬ মে ২০১৭