এদেশে ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা ,উদ্যোক্তা ও বাস্তবায়নকারীরা দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ‘ ধূর্ত শিয়াল ও কুমীর ছানা ’র গল্পের মতো দারিদ্যমুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে দারিদ্র্যকেই লালন করছে বলে মন্তব্য করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এসব ক্ষুদে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান হতদরিদ লোকদেরকে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের মহিলাদের তাদের দারিদ্র্য মুক্তিতে সহায়তা করার স্বপ্ন দেখিয়ে বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দান করে থাকে। এদের মজবুত সাংগঠনিক স্থাপনা ও কাঠামোসহ থাকে প্রয়োজনে পুলিশী সহায়তা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা।
এরা সুদূর গ্রাম গ্রামান্তরে শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করে মানুষদের অর্থনৈতিক সেবাদানের নামে কৌশলী দাদন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের নিয়মকৃত বেঁধে দেওয়া সময়ও নিয়মের অধীনে সুদ ও চক্রবৃদ্ধির হিসেবমতো ঋণ পরিশোধে অপারগ গ্রহীতাদের অনেকেরই অসহনীয়, অবর্ণনীয় ও অবমানানকর দুর্ভেগ পোহানোর বহু খবরাখবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।
এরূপ ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে হাজতবাসসহ তাদের ঘরের মালপত্র, পালিত পশু ও ঘরের চালার টিন বিক্রি, এমনকি ভিটে মাটি হারানোর মতো কাহিনীও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। উল্লেখ্য যে, এমন মহাজনী দাদন ব্যবসা করে নিষ্ঠুরের মতো হতদরিদ্রদের নিকট থেকে চক্রবৃদ্ধিসহ সুদেমূলে আদায়কারী কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তি বিশেষরা প্রচুর অর্থ-বিত্ত-বৈভব অর্জনসহ খ্যাতি, উপাধি, পুরষ্কারলাভ করে ধন্য ও বরেণ্য হচ্ছে।
তবু আজ পর্যন্ত এমন একটা নজির স্থাপনের দৃষ্টান্ত নেই, যাতে হতদরিদ্র মানুষের এমন শুভাকাঙ্খী উপকার সাধনকারী কোন একটা সংস্থা দুর্ভগা অপারগ কোন ঋণগ্রহীতার ঋণ, তার সুদ বা চক্রবৃদ্ধি মাফ করে দিয়েছে। ঋণদান চক্রের মারপ্যাঁচটা এমন কৌশলে প্রণয়ন করিয়ে নেওয়া হয়েছে যে এসব মহাজনী সুদখোর দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শেরে বাংলা ফজলুল হকের গৃহীত ঋণসালিশী বোর্ড গঠন করারও কোনো উপায় আছে কিনা আমার জানা নেই।
হতদরিদ্র জনগোষ্ঠরি দারিদ্র্য বিমোচন এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নার্থে এমন দরদী ও উপকারী সংস্থাগুলোর বার্ষিক কার্যবিবরণীতে কী পরিমাণ ঋণগা্রহকের মধ্যে কত টাকা লগ্নি করা হয়েছে, সুদে-আসলে চক্রবৃদ্ধিসহ কত টাকা আদায় করা হয়েছে, ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে কতজন সফল বা উপকৃত হয়েছে- তার একটা পূর্ণাঙ্গ বিবরণী প্রকাশিত হলে তাদের কৌশলগত ব্যবসায়িক শুভঙ্করের ফাঁকিটা অবগত হওয়া যেত।
ঋণ নেওয়া পরিবারগুলোর ঋণ পরিশোধের অপারগতার অবস্থা যাচাইপূর্বক তাদেরকে সহায়তা করার জন্যে সরকারের দিক থেকেও একটা প্রচেষ্টা গ্রহণের নীতিমালা থাকা উচিত ছিল। বেশুমার জানমাল বিসর্জনসহ মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন গণপজাতন্ত্রী দেশটিতে প্রান্তিক তথা হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ভয়াবহ দারিদ্র্য, এমনকি দারিদ্র্যসীমারও নীচে থেকে ন্যুনতম ভালোভাবে বাঁচার অধিকার বঞ্চিত থাকবে এমনতো হবার কথা নয়। স্বাধীনতা লাভের পেছনে এসব মানুষদেরও যথেষ্ট গুরুত্বপূূর্ণ ত্যাগ ও অবদান ছিল।
তাহলে দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতেইতো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। মনে রাখতে হবে, একটি দেহের কোন একটি ক্ষুদ্র অঙ্গও যদি রোগগ্রস্ত বা ক্ষতগ্রস্ত অবস্থায় থাকে তবে ঐ দেহটিকে সুষম দেহ বলা যেতে পারেনা। পুরো দেহের সুস্থতার জন্যে দেহের রোগগ্রস্ত বা ক্ষতগ্রস্ত ঐ অঙ্গটিকে যত শীঘ্র ও যথাসম্ভব যথাযথভাবে চিকিৎসাপূর্বক সারিয়ে তোলা জরুরি।
তা নাহলে রোগ বা ক্ষতগ্রস্ত দেহটি নিয়ে ঐ ব্যক্তিকে ধুঁকে ধুঁকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তেমনি একটি জাতি বা রাষ্ট্রের একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে অধিকার বঞ্চিত করে অবহেলা ও দারিদ্র্যের মধ্যে রেখে রাষ্ট্রের গায়ে যতোই সোনার কাঠি স্পর্শ করানো হোক, সেটা হবে একটা রোগগ্রস্ত ও ক্ষতগ্রস্ত দেহকে বিনা চিকিৎসা ও বিনা শুশ্রষায় সুস্থ করে তোলার প্রচেষ্টার মতো।
তেমনি একটা শান্তিপূর্ণ পরিবারের মধ্যে যদি একজনের জীবন কোনোভাবে রোগগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত হয়, তবে ঐ পরিবারে সুখ-শান্তির আবহটা কোনো মতেই স্বস্তিদায়ক থাকেনা। যেকোনো সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানের বিষয়টা মহান স ষ্টারই এক অপার রহস্যে আবৃত। কেউ কেউ বংশ পরম্পরায় বা পবািরগতভাবেই প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে থাকে।
আবার কেউ কেউ অতি দারিদ্রাবস্থা থেকেও উত্তরণ লাভ করে বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যায়। তাই বলা হয়ে থাকে যে, বিশেষ বিশেষ অবস্থা বা সীেভাগ্য বা দুর্ভাগ্য বশতঃ কেউ কেউ সকালের ফকিরি অবস্থা থেকে বিকেলে আমীর বনে যায়, আবার কেউ কেউ সকালের আমীরি অবস্থা থেকে বিকেলে ফকিরে পরিণত হয়।
তবে ইসলামের মহান নবী মুহম্মদ (সা.) পনের শ বছর পূর্বে ধনী-দরিদ্রের আকাশচুম্বী ব্যবধান, শত সামাজিক অনাচার ও কুসংষ্কার বেষ্টিত বর্বরতম মরুর দেশে জন্মগ্রহণ করার সময়টা ছিল একটা কঠিন সময়। মানবপ্রেমী সেই মহান নবী কুসংষ্কারাচ্ছন্ন সেই মরুর দেশে শান্তি-সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সমগ্র জগতের সর্বকালের সর্বজাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এসেছেন।
তিনি আরব সমাজকে সর্বপ্রকার কুসংষ্কারমুক্ত করে ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার ব্যবধানকে সমতায় নিয়ে এসেছিলেন। কীভাবে এটা সাধিত হয়েছিল? সমাজের মানুষদের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান ঘুচিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠাকল্পে সহানবী (সা.) মহান আল্লাহর নির্দেশে (পবিত্র কুরআনের সূরা নিসায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত বিধানানুসারে) যাকাত প্রথা চালু করেছিলেন।
তাতে খুব জটিল কোনো অংকের মারপ্যাঁচ নেই। যাকাত বিধানের সহজ হিসেবটা হলো এই যে, সমাজের অর্থশালী প্রতিটি ব্যক্তি বার্ষিক হিসেব অনুযায়ী তাদের অর্থ-সম্পদের মাত্র শতকরা আড়াই ভাগ দীনহীন দরিদ্রদের নিঃশর্তে দান করবে।
এই শর্তানুসারে দরিদ্রদের মধ্যে যাকাতের অর্থ বন্টনের মাধ্যমে মহান নবীর জীবৎকালের শেষ দিকে সমগ্র আরব রাষ্ট্রে যাকাত নেওয়ার মতো কোন লোক পাওয়া যেতোনা বলে সেখানে কোনো লোকই আর দরিদ্র থাকেনি। তারপরও যাকাতের অর্থ ঠিকই আদায় হতো এবং ঐ অর্থ জনস্বার্থে সামাজিক উন্নয়ন কাজে ব্যবহূত হতো। সেই থেকে সমগ্র মুসলিম জগতে যাকাত প্রথা প্রবর্তিত হলেও স্বার্থান্ধ লোভী ধনী মুসলমানরা যাকাততো দূরে থাক সরকারী করও সঠিক হিসেব মতো প্রদান করে না।
তাই তথাকথিত মুসলমান নামধারী সম্পদশালীরে বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলা চলে। তার পরও কীভাবে কতো কম কর প্রদান করে পার পাওয়া যায় সেই চেষ্টাই করে থাকে। অর্থগৃধ্নু স্বার্থপর প্রভাবশালী ধনবানরা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অধিকাংশটাই নানান ফাঁকি-ঝুঁকির মাধ্যমে নিজেদের কবলে কব্জা করে রাখতে চায় বলেই দিনে দিনে সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েই চলেছে।
ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানজণিত কারণেই সমজের মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতিমূলক সম্পর্কের অভাব। তাতে দারিদ্র্য কবলিত মানুষরা অপরাধ পবণতার দিকে যেমন ধাবিত হয়, তেমনি লোভী স্বার্থান্ধ ধনীরা নানান প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যেভাবেই পারা যায় দরিদ্রদের শোষণ করে, রাষ্ট্রের কোষাগার শূণ্য করে নিজেদের কোষাগার বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকার কারণে সমাজে বৈষম্য,অপরাধ, দুর্নীতি ও অশান্তিতে আজ সাধারন জীবনযাপন সার্বিকভাবে বিপর্যস্ত।
বাণিজ্য কেলেংকারী, ব্যাংক কেলেংকারী, ঋণ কেলেংকারী, ভেজাল কেলেংকারী, সিণ্ডিকেট কেলেংকারীসহ সর্বশেষ দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির শীর্ষে চলমান পেঁয়াজ কেলেংকারীতে দেশের ভূক্তভোগী সাধারণ মানুষদের নাভিশ্বাস উঠেছে। সত্যিকারে কোনো মুসলিম রাষ্ট্র বা সমাজে এমনটা হতেই পারে না। কিন্তু এদেশের মানুষদের দুর্ভাগ্য যে, বীর বাঙালী খ্যাত স্বাধীন মুসলিম দেশটিতে এমন অমুসলমানি অরাজকতাই চলছে।
দেশের সর্বস্তরের শিক্ষালয়, উপাসনালয়, ব্যবসা-বানিজ্য সব কিছুতেই চরিত্রহীনতা,অসততা, অশ্লীলতা, অস্থিতিশীলতা বর্তমানে নিত্য-নৈমিত্তিক অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। হায়রে ধর্ম! হায়রে ইসলাম! হায়রে নীতি-নৈতিকতা! উন্নয়নের পথে ধাবিত হওয়ার পাশাপাশি বর্তমানকার অরাজক অবস্থা তথা মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে মূলত আমরা কী অগ্রগতি নাকি অধপতনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি তা ভেবে কোনো কূল পাচ্ছি না।
দেশের সনামধন্য লেখক-শিক্ষাবিদ স্বপ্নচারী মুহম্মদ জাফর ইকবালের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা-জোখায় প্রায়ই আশ্বাসজণিত আশার বাণী ধ্বণিত হতে দেখে ভালো লাগে। এজন্যে তাকে কৃতজ্ঞতাসহ ধ্যবাদ জানাই। হাজারো দুরবস্থা ও ক্রমবর্ধমান অরাজক অশান্তির মধ্যেও স্বপ্নীল আশা পোষণকারী ও আশার বাণী শোনানোর মতো লোকওতো নেই আমাদের মধ্যে।
আশা করি উচ্চাশা পোষণকারী সাহসী বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো স্বপ্নচারী ও অক্লান্ত পরিশ্রমী নেতৃত্ব দানকারীরা দেশকে স্বদেশী-বিদেশী ঋণ-খয়রাত দানকারী স্বার্থবাজ সংস্থার দান-খয়রাতের কপট উদারতা থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করে দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন কবলমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ কল্যাণকর একটা সমাজ ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবেন।
দেশের ধনবান ও ভাগ্যবান মুসলমানদের প্রতি নিবেদন, মুসলমান হিসেবে কুরআন হাদিস নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী তারা যদি ‘ধনীদের সম্পদে গরিবদের হক রয়েছে’- বিষয়টা অনুধাবন করে নিজ নিজ আপন জন ও দরিদ্র প্রতিবেশীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হন এবং দেশের কল্যাণের প্রতি নিবেদিত হন তাহলেই দেশটা অচিরেই দারিদ্র্যমুক্ত শান্তির দেশে পরিণত হতে পারে। আমাদের প্রিয় দেশটা সকলের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাপূর্ণ প্রচেষ্টায় দারিদ্র্যমুক্ত, ঋণমুক্ত, দুর্বৃত্তমুক্ত, সুদমুক্ত একটা সন্মানজনক স্ব-নির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত হোক, সকলের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, দেশের প্রতিটি মানুষ সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক- মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।
লেখক : নূরুল আমিন চৌধুরী। সাবেক অধ্যক্ষ, ভুলুয়া কলেজ, নোয়াখালী, গবেষক ও কলামিস্ট।
উৎসঃ দৈনিক আমার সংবাদ
প্রকাশকালঃ নভেম্বর ১৮, ২০১৯,