ইসলামে সম্পদ বণ্টনের নীতিমালা মহাগ্রন্থ আল কুরআনেই দেয়া আছে। আল কুরআনের সূরা হাশরে বলা হয়েছে, ‘কাই লা ইয়াকুনা দুলাতান বাইনাল আগনিয়ায়ে মিন কুম’ (যেন সম্পদ কেবল ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়)। আল্লাহর এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিত হচ্ছে মদিনায় ইহুদি বনি নজির গোত্রের সাথে দ্বন্দ্বের পর তারা মদিনা ত্যাগ করে চলে যায় এবং তাদের পরিত্যক্ত মালসম্পদ ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত হয়। ইসলামের পরিভাষায় এই সম্পদকে ‘ফাই’ বলে অর্থাৎ যে সম্পদ ইসলামী রাষ্ট্র বিনাযুদ্ধে হস্তগত করেছে। বনি নজির থেকে পাওয়া এই ফাই সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, এটা হচ্ছে ‘আল্লাহ তায়ালার জন্য, রাসূলের জন্য, নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের জন্য, ইয়াতিম ও মিসকিনের জন্য এবং সম্বলহীন পথিকদের জন্য; যেন সম্পদ তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।’ (সূরা হাশর আয়াত নং ৭)। এখানে লিল্লাহ (আল্লাহর জন্য) বলতে বুঝায় রাষ্ট্রের সব কাজকর্মের জন্য। এই লিল্লাহ খাত থেকে রাষ্ট্রের যা কিছু করা দরকার তা করতে পারবে।
এ আয়াতে ইসলামের বণ্টননীতি স্পষ্টভাবে দেয়া হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের বণ্টননীতির ভিত্তি হচ্ছে এ আয়াত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্র বণ্টনের ক্ষেত্রে কী কী করবে? প্রথমত রাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় সম্পদ দ্বারা অসহায়দের ব্যবস্থা করবে, তাদের ভাতা দেবে। দেশে অনেক বেকার থাকে। আমাদের দেশে অনেক বেকার রয়েছে। তাদের কর্মসংস্থান না হলে এই সম্পদ থেকে বেকারভাতা দিতে হবে।
এই আয়াতের দাবি যে, শ্রমিকদের মজুরি আরো ভালো হবে যাতে ব্যাপক বণ্টন হয়। বর্তমানে শ্রমিকদের বেতন অনেক কম। কিন্তু সম্পদ বণ্টনের নীতির দাবি যে, লাভ কম হলেও শ্রমিকদের মজুরি উন্নতমানের দিতে হবে। এ ব্যাপারে রসূলের নির্দেশ আছে, তিনি বলেছেন যে, তোমরা যা খাও, শ্রমিকদের তা-ই খাওয়াবে, তোমরা যা পরো তা-ই পরতে দেবে। এ থেকে বুঝা যায়, রাসূল এটাই চাইতেন যে, শ্রমিকদের জীবন ধারণের মান যেন উন্নত হয়। শ্রমিক মালিকের সম্পদ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু জীবন ধারণের মান শ্রমিকদের ন্যায্য ও ভালো হতে হবে, এটিই রাসূলের শিক্ষা। সুতরাং শ্রমিকদের অধিকার বাড়াতে হবে, তাহলে অতি ধনী কম হবে এবং সম্পদের পার্থক্য কমে আসবে। এই আয়াতের এটাও দাবি যে, মুনাফাখোরি চলবে না। মালের অতিরিক্ত দাম নেয়া যাবে না। মজুতদারি করা যাবে না। রাষ্ট্র এইসব বিষয় দেখবে। বর্তমানে যে সম্পদের বৈষম্য আছে তা কমিয়ে আনা এই আয়াতের দাবি। নানাভাবে সরকারকে ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে সম্পদ কিছু লোকের হাতে পুঞ্জীভূত না হয়। ব্যবসার দিকে দেখভাল অনেক বেশি করতে হবে। বর্তমান বৈষম্য কমানোর জন্য সরকার আগের আয়েরও হিসাব নিতে পারে যে, তা বৈধভাবে করা হয়েছিল কি না। যদি দেখা যায় কিছু ব্যবসায়ীর সম্পদ অবৈধভাবে করা হয়েছে, মুনাফাখোরি করা হয়েছে তাহলে সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। এটা অবশ্য বারবার করতে হবে না। যখন নতুন করে এই আয়াতের আলোকে কোনো রাষ্ট্র সম্পদ পূর্ণ বণ্টনের চিন্তা করে তখন একবারই তা করতে হবে। বারবার করতে হবে না।
শেষে আমি বলব যে, ইসলামী অর্থনীতির তিন-চারটি প্রধান মূলনীতির মধ্যে একটি হচ্ছে সুদ নিষিদ্ধ করা, একটি হচ্ছে জাকাত প্রবর্তন করা, একটি হচ্ছে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যে রাষ্ট্রে অসহায়দের দায়িত্ব সরকার নেয়, একটি হচ্ছে সম্পদের পূর্ণ বণ্টন করা। যেটা এই আয়াতের দাবি। যেটা আমরা উপরে কয়েকবার উল্লেখ করেছি। আশা করি, ইসলামী সংগঠনগুলো সূরা হাশরের এই নীতি উপলব্ধি করবে এবং বাস্তবায়নের চিন্তা করবে। আমি যা বলেছি, সমাধান তা না-ও হতে পারে। সমাধান অন্য কিছু হতে পারে। আমি ইসলামী চিন্তাবিদ ও অর্থনীতিবিদদের অনুরোধ করি যেন তারা এই বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন এবং মুসলিম বিশ্বে সব দেশে এটাকে কার্যকর করার চেষ্টা করেন।
লেখক :শাহ্ আব্দুল হান্নান, সাবেক সচিব বাংলাদেশ সরকার।
উৎসঃ দৈনিক নয়াদিগন্ত
প্রকাশঃ ২১ মে ২০২০,