ধর্ম মানেই মানবিকতা। মানুষের জন্য করা। নবীজীর জীবনের দিকে তাকালে দেখি, তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধা সহজ-সরল মানুষ। মানুষের জন্য অন্তর থেকে অশ্রু বর্ষণকারী একজন মানুষ। সবার দুঃখ কষ্ট দেখে নিশ্চুপ বসে থাকার মানুষ তিনি ছিলেন না। তাই যারা তাঁর অনুসারী বলে দাবি করি তাদেরও উচিত মানুষের দুঃখ কষ্টে সহমর্মিতা নিয়ে এগিয়ে আসা।
এই করোনার দুর্যোগকালে অভাবী, অসুস্থ ও কর্মহীন মানুষের পাশে অর্থ, খাদ্য ও অন্যান্য সেবা (যেমন চিকিৎসা সেবা, দাফন সেবা ইত্যাদি) নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত নবীজীর (স.) সকল অনুসারীদেরই।
বদরের যুদ্ধে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেও রাসুল (সা:) হযরত ওসমান (রা:)কে যুদ্ধে না গিয়ে তাঁর অসুস্থ স্ত্রী হযরত রুকাইয়া (রা:)-এর সেবাযত্নের জন্য থেকে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং এ সিদ্ধান্তটি স্বয়ং আল্লাহ এতই পছন্দ করেছেন যে, এজন্য হযরত ওসমান (রা:)কে বদরী সাহাবী হিসেবে আখ্যায়িত করার এবং যুদ্ধলব্ধ সুবিধাদিতেও তাঁকে অংশীদারের নির্দেশনা জানিয়েছেন।
উক্ত ঘটনাটিও যেখানে রুগীর সেবাযত্ন ও পরিচর্যার গুরুত্বারোপ করে, সেখানে বর্তমান বিশ্বের মানবতা বিবর্জিত আচরণ সত্যি বেদনাদায়ক। অবশ্য সমাজসেবার লেবাস দেখিয়ে মানুষেদের যেখানে প্রতারিত করে সর্বহারা করা হচ্ছে, সেখানে ভিক্ষুকের জমানো টাকা দান করার ও বিকাশ ব্যবসায়ীর ৮০ লক্ষ টাকা পেয়ে তা ফেরত দেয়ার নমুনাও আছে। তৎসঙ্গে মানবতা বিপন্নের সন্ধিক্ষণে যেখানে প্রিয় সন্তানও পিতামাতার দাফনে না এসে পালিয়ে বেড়ায়, সেখানে মানবতাবাদী সংগঠন কোয়ান্টাম সদস্যদের ৭ শতাধিক করোনা লাশ দাফনের দায়িত্ব পালনের বিষয়টিও যেমনি প্রশংসার, তেমনি চাঞ্চল্যকরই বটে।
কোয়ান্টাম পরিচালিত কসমো স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাও একদিকে যেমন দেশের এতিম, অনাথ, গরিব, মিসকিনদের এক বড় অংশ, তেমনি কোয়ান্টামের স্নেহ ও মমতার পরশ পাথরের সংস্পর্শে গড়ে উঠছে সৎ ও যোগ্য সুনাগরিক হিসেবেও। এদের যেকোন প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসাকে শুধু দান বা দয়া বলা যায় না বরং তা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যেরও অংশ, যা কুরআন বর্ণিত যাকাতের ৮ খাতেও শামিল। তাছাড়া যাকাত ও কোরবানির অর্থ ব্যয় হয় বাৎসরিক, অথচ দান করতে হয় প্রতিদিন নিয়মিত। তাইতো রাসূল (সা:) বলেছেন স্রষ্টার কাছে ঐ আমল বেশি পছন্দের যা নিয়মিত করা হয়।
তাই প্রতিদিনের নিয়মিত ব্যয়ের পাশাপাশি নিয়মিত দানেও অভ্যস্ত হওয়া এবং যাকাত-কোরবানির একটি অংশকেও বিশেষ দান হিসেবে দিতে পারাটাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক।
কোরবানি দেয়া ওয়াজিব। যার ওপর যাকাত ফরজ তার ওপরই কোরবানি ওয়াজিব। তারপরও অনেকে নানা কারণে এবার কোরবানি দিতে পারবেন না বলেই মনে হচ্ছে। অনেক মানুষ একসাথে জড়ো হওয়াটা এখনও নিরাপদ নয়। যদিও স্বাস্থ্যবিধি মেনে একসাথে কাজ করা শুরু হয়েছে। তাছাড়া, গরুর হাটে যাওয়াটাকেও অনেকে নিরাপদ মনে করছেন না। সেক্ষেত্রে অনেকে ঝুঁকছেন অনলাইন গরু কেনার দিকে। কিংবা অন্য কোথাও অন্য কারও ওপর দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছেন কোরবানি করার। বাস্তবিক কারণে অনেকেই হয়তো কোরবানি দিতে পারবেন না বা দিবেন না। যাদের কোরবানি দেয়া সম্ভব হবে না, আগে থেকেই কোন সেবা খাতে সেটা দান করার পরিকল্পনা করে রাখা তাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। যেমন অভাবী অন্নহীন মানুষের কাছে নগদ অর্থ বা খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া। কিংবা যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করোনায় মৃতদের দাফন/সৎকার করছেন তাদেরকে নগদ অর্থ বা এ্যাম্বুলেন্স, ফ্রিজার ভ্যান সরবরাহ করা ইত্যাদি।
কোরবানি না দিয়ে সেই অর্থ পুরোপুরি দান করে দিতে বলাটাও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং যারা কোরবানির সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা দিতে পারবেন না তাদেরকে সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করা। যারা দেবেন তারা তো যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই দেবেন আশা করি।
একই সাথে আশা করি, তারা কোরবানির জন্য বরাদ্দ করা বাজেট থেকে কিছুটা দান করবেন ত্রাণ, দাফন ইত্যাদি কাজেও। এতে বড়, বেশি দামি পশু ক্রয় ও লোক দেখানো কোরবানির প্রবণতাও কমবে, কিছুটা বন্ধ হবে মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে ফ্রিজ ভর্তি করার প্রবণতাও।
পরিশেষে উক্ত বিষয়ে ভাবতে, সিদ্ধান্ত নিতে ও স্বীয় ভূমিকায় এগিয়ে আসার আহবানসহ স্রষ্টার সাহায্য চেয়ে শেষ করছি।
লেখক: আবদুল হালীম (হিলালি); ইসলামি চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, মুফাচ্ছির ও খতিব, চট্টগ্রাম।
উৎসঃ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ। দৈনিক অধিকার,
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২০,